৪) ইজতেমায় যাওয়ার পিছনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণ ছিলো, আমার প্রবাসী দুলাভাইয়ের আব্বুর অনুরোধ। তিনি অনেকদিন যাবত তাবলীগ জামাতের সাথে আছেন। মারকাযের মুরব্বীদের সাথেও তাঁর বেশ সম্পর্ক। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠান এবং ইজতেমায় অংশ নিতে দেশে এসেছেন।
ইজতেমা উপলক্ষে তাঁর গ্রাম থেকে নিজ দায়িত্বে প্রায় ৬০ জন লোককে নিয়ে ইজতেমায় গেছেন। আমাকেও তাঁর সাথে যাওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। পূর্ব থেকে আমারও বেশ ইচ্ছে ছিলো যাবো। তাঁর অনুরোধের পর সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমি যাচ্ছি।
যাওয়ার বিষয় নিশ্চিত হবার পর ভাবলাম, থাকবো কোথায়? তালই সাহেবের জামাতে থাকার কথা ভাবতে পারছিলাম না। কেননা, শুধুমাত্র তিনি ছাড়া কারো সাথেই পরিচয় নেই।
মাদরাসার জামাতের এক ভাইয়ের সাথে আলাপ করলাম। শুনে বেশ খুশি হওয়ার পাশাপাশি স্বেচ্ছায় তাঁদের সাথে থাকার অনুরোধ করলেন। এলাকার জামাতের ২/১ জনকে শুধু বললাম, আমি আসছি। তাঁরাও জোর করে ধরলেন, আমি যেন তাঁদের সাথে থাকি।
২২ জানুয়ারি বুধবার আমার এক দুঃসম্পর্কের খালুর কাছ থেকে তাবলীগের মাধ্যমে পরিচিত এক ভাই জানতে পারলেন, আমি বৃহস্পতিবার ইজতেমায় যাবো। খালুকে বললেন, আমাকে যেন তিনি তাঁদের সাথে (দায়িত্বপ্রাপ্তদের নির্ধারিত স্থানে) থাকার কথা বলেন।
খালু আমাকে বললেন, অমুক ভাই তোমাকে তাঁদের সাথে থাকতে বলেছেন। আমি বেশ খুশি হলাম। যদিও থাকবো কি না নিশ্চিত ছিলাম না। কেননা, সেই ভাইয়ের সাথে পূর্ব অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়।
মাদরাসার জামাতের বেশিরভাগ সাথী যেহেতু পরিচিত। যাঁদের মাঝে আমার এক সহপাঠীও ছিলো। এছাড়া স্বাধীনতাও সবচেয়ে বেশি পাওয়া যাবে। এসব ভেবে ২৩ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার বিকেলে রওয়ানা দেয়ার সময় অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম, মাদরাসার জামাতের সাথে থাকবো।
বৃহস্পতিবার (২৪ জানুয়ারি) রাত ২:৩০ এর দিকে ইজতেমায় পৌঁছার পর ভোরে সর্বপ্রথম তালই সাহেবের সাথে সাক্ষাতের পর সেই তাবলীগী ভাইয়ের সাথে দেখা করে তাঁদের সাথে থাকছি না বলতে গেলাম।
দেখলাম একজন মেহমানকে নিয়ে তিনি গল্পে ব্যস্ত। আমাকে দেখে হাত মিলিয়ে ব্যাগ থেকে বেশ ভালো একটি খেজুর উপহার স্বরূপ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, আপনার সাথে আমি একটু পরে যোগাযোগ করছি। এখন একটু ব্যস্ত। আমিও কিছু না বলে হাটা ধরলাম আর মনে মনে ভাবলাম; আপনি দেখা না করলে বরং আমি অধিক খুশি হবো। এমনিতেই তো আপনার সাথে থাকার ইচ্ছে ছিলো না। ভাবছিলাম, না করার পর আপনার খারাপ লাগে কি না। আমার কাজটা আপনি সহজ করে দিলেন। এও ভাবলাম, যা কিছু হয় আল্লাহ্ তায়ালার পক্ষ থেকেই তো হয়। আমার ভাগ্য নিঃসন্দেহে ভালো যে, এমন একজনের উপর নির্ভরশীল হবার কথা ভাবিনি; যে কি না কয়েক ঘণ্টা পূর্বে গুরুত্ব সহকারে দেয়া দাওয়াতকে তুচ্ছ মনে করে।
৫) বৃহস্পতিবার রওয়ানা দেবার পর মাদরাসার এক সাথী আমায় নির্ধারিত জায়গায় নেয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলো। অধিক মমতার কারণে রাতের খাবার থেকে আমার জন্য সামান্য অংশ পর্যন্ত রেখে দিয়েছিলো। রাত ১:০০ ঘটিকায় তাঁর সাথে আমার সর্বশেষ যোগাযোগ হয়। কিন্তু অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।
পরদিন ফজরের পূর্বে তাঁর ফোন আসে। রাতে ঘুমিয়ে পড়ার কারণে দুঃখ প্রকাশ করে। আমি এমনিতেই বুঝতে পেরেছিলাম যে, অনিচ্ছায় সে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমাদের গাড়ী যেহেতু দেরি করেছিলো। এজন্য দায় সম্পূর্ণ আমাদের। বেচারা তো কষ্ট করে রাত ১:০০ পর্যন্ত জেগে ছিলো।
ফজরের নামাজের ঘণ্টা খানেক পর নির্ধারিত জায়গায় গিয়ে পৌঁছুলাম। রাতে ঘুমোতে পারিনি বলে সাথে সাথে সেখানে ঘুমিয়ে পড়লাম। ৯:০০ ঘটিকার দিকে কে একজন নাস্তা করার জন্য আমায় ডেকে তুললো।
বিশাল এক থালায় আমি, আমার সহপাঠী এবং দরগাহ এলাকার দুই মুরব্বী বসলাম। এমনিতে আমি ধীরে ধীরে খাই। সেদিনও একটু একটু করে খাচ্ছি, আচমকা মনে হলো; আরে আমি তো টাকা না দিয়েই খাচ্ছি! সহপাঠীকে আস্তে করে বললাম; আমি যে টাকা দিলাম না! কতো দিতে হবে বলতে পারবে কি? সে তখন বললো: সময় হলে দিবে; এখন খাও তো। আমরা কথা বলছি, আচমকা এক মুরব্বী বললেন; কি হয়েছে। আপনি খাচ্ছেন না কেন? আমার সহপাঠী কৌতুক করে বলে উঠলো; তিনি টাকা দিতে পারেননি তো, তাই খাচ্ছেন না। ভঙ্গি দেখে বুঝলাম, মুরব্বী ভেবেছেন; আমার সাথে সম্ভবত টাকা নেই। বললেন; আরে, চিন্তা করছেন কেনো! আপনি খান। টাকা পয়সা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আমি তখন হতভম্ব। সহপাঠী তখন মুখ ঘুরিয়ে হাসছে। আমিও তাঁর হাঁসি দেখে বেশ হাসলাম।
সিলেটে আসার পর হিসেব করে দেখলাম, পুরো ইজতেমায় আসা, যাওয়া, খাওয়া উপলক্ষে যা খরচ হয়েছে, তার চেয়ে অন্তত দশগুণ বেশি টাকা আমার পকেটে ছিলো। চাইলে ২/৩ চিল্লা দিয়ে আসতে পারতাম।
>ইজতেমার বিশেষ নোটবুক থেকে…… ফেসবুকে প্রকাশিত