আমার নানা আহমদ হোসেন সাহেব ব্রিটিশ শাসনামলে ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী বয়স ১০০ ছাড়িয়ে গেছে। কানাইঘাট, বিয়ানীবাজার অঞ্চলে বিচারক হিসেবে তিনি বেশ পরিচিত। সম্প্রতি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তবে একাকী বাড়ী থেকে আমাদের বাসা পর্যন্ত চলে আসতে পারেন। ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় গত সপ্তাহে অন্য সময়ের চাইতে একটু বেশিই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ৪/৫ দিন হয় আমাদের বাসা থেকে কেবল বাড়িতে গেছেন। আজ বেলা ১১ –টার দিকে সবার অজান্তে বাড়ী থেকে বেরিয়ে পড়েন। আমি মাদরাসা থেকে বাসায় আসার পর সন্ধ্যার সময় আম্মু বললেন; নানা ১১ –টার দিকে বাড়ী থেকে বেরিয়েছেন। এখনো পর্যন্ত কোনো সন্ধান নেই। শুনে চমকে উঠলাম। বাড়ী থেকে বেরিয়েছেন মানে আমাদের বাসায় আসছেন। অনেক আগেই তো চলে আসার কথা। অন্য আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে খুঁজ নিয়ে জানা গেলো কোথাও নেই। ততোক্ষণে সবার টনক নড়েছে। চারিদিকে খুঁজাখুঁজি শুরু হলো। সিলেটে এসেছেন নাকি আসেননি এই বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিলো না। অবশেষে এলাকায় মাইকিং করানো হলে রাত ৮:৩০ -এর পর ২/৩ জন নিশ্চিত করলেন যে, তারা নানাকে সিলেটে আসতে দেখেছেন। অদ্ভুত জটিলতা। সিলেটে আসছেন কিন্তু আমাদের বাসায় আসেননি। তবে গেলেন কোথায়? কোনো কিছু ভাবতে পারছিলাম না। এদিকে আবার আম্মুর প্রেশার বাড়ছেই……… আমি চোখ তুলে দেখতে পারছি না। কিছু করতেও পারছি না।
অবশেষে রাত ৯:০০ –টার দিকে ছোট দুলাভাই আসলে পরামর্শে বসলাম। পরিচিত এক ওসির মাধ্যমে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে নিখোঁজ সংবাদ জানানো হলো। রাত হয়ে যাওয়ার কারণে ভোরে সিলেট শহরে মাইকিং করানোর সিদ্ধান্ত হলো। মেডিক্যাল চেক করার বিষয়টা মাথায় ছিলো। পরিচিত ওসি সাহেব একই পরামর্শ দিলেন। সবকিছু ঘুচিয়ে রাত ১০:৩০ –এর দিকে আমি, দুলাভাই ও লিডিং ইউনিভার্সিটিতে পড়ুয়া ভাগনা মুশাহিদ ওসমানী মেডিক্যালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। এরপরের সবকিছুই যেন স্বপ্ন……… হাউজিং এস্টেট গেছি, এমতাবস্থায় আম্মু ফোন করে বললেন; “আদিব (আমার ভাগ্নি সম্পর্কীয় নাতি) দুপুরে দরগাহ’র প্রধান গেইটে নানাকে দেখেছে।” আমি কেবল শুনেছি যে, আদিব দরগায় দেখেছে। দুপুরে দেখেছে এই কথাটা শুনতে পাইনি। ড্রাইভারকে দরগায় যেতে বললাম। মনে হচ্ছিলো দরগাহ’র মেইন গেইটে গেলেই হয়তো পেয়ে যাবো। ড্রাইভার ততোক্ষণে ঝর্নার পার এলাকায় গাড়ী প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে। কি আর করা। দুলাভাই বললেন; এদিক দিয়েই যাই। আমি তখন ঠিক কোন জায়গায় দেখেছে জানার জন্য আদিবকে ফোন দিলাম। সে যখন বললো; দুপুরে দেখেছে। হতাশ হয়ে পড়লাম। দরগাহ মসজিদের মিনারা’র একটু সামনে গাড়ী সাইড করে পরামর্শ করলাম; এখন কি করা যায়! দুলাভাই বললেন; যেহেতু দুপুরে দরগাহ পর্যন্ত ভালোমতো চলে এসেছেন। তার মানে ওসমানীতে গিয়ে আর লাভ নেই। তারচেয়ে আমরা দরগাহ এলাকায় খুঁজে দেখি। আমি তখন ভাবছি; এমন তো হতে পারে যে, দরগাহ থেকে বাসায় পৌঁছার পূর্বেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ফলে কেউ মেডিক্যালে ভর্তি করিয়েছে। তবুও দুলাভাই’র প্রস্তাব মেনে নিলাম। গাড়ী ঘুরিয়ে ঝর্নার পার দারুল ইক্বামা বিল্ডিঙের পাশে আসলাম। দুলাভাই ও ভাগনা দরগাহ’র মাঠ খুঁজতে গেলেন। আমি আশেপাশে খুঁজতে লাগলাম। একটু পরেই ভাগনার ফোন। মামা> পেয়ে গেছি। বললাম; কোথায় পেয়েছে? পুকুরের পার্শে অজু করছেন। এমতাবস্থায় পেয়েছি। একটু অপেক্ষা করুন। নিয়ে আসছি। আমি সাথে সাথে তখন আম্মুকে ফোনে সবকিছু বললাম। প্রেশার বৃদ্ধির ফলে ধারণকৃত রক্তিম চেহারায় শুভ্রতা ফিরে আসছে ভেবে ভালো লাগছিলো। গাড়ী ঘুরিয়ে একটু পিছনে নিলাম। দুলাভাই হাত ধরে নিয়ে আসলেন। গাড়িতে বসালেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসায় চলে আসলাম। গাড়িতে বসে রাগ করে বললাম; আমি এতবছর ধরে পড়ি। জীবনে কখনো দরগায় আসতে দেখলাম না। আজ এমন কি হলো যে, দরগায় একেবারে রাত কাটাতে চলে আসলেন। উত্তরে বললেন; আমাদের বাসা নাকি তালাবন্ধ ছিলো। তিনি ভেতরে প্রবেশ করতে পারেননি। ফলে রাত কাটানোর জন্য দরগায় চলে আসছেন। বুঝলাম, ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এখনো কাটেনি। হয়তো বাসার পথেই ছিলেন। পথিমধ্যে কিছু মনে হয়েছে আর দরগায় নেমে পড়েছেন। তবে আলহামদুলিল্লাহ্ যে, আমাদের চিনতে পারছেন। সবাই নানার জন্য দোয়া করবেন যেন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেন। ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ফেসবুকে প্রকাশিত