আমাদের মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ভালো-মন্দ কিছু বলব,এমনটি চিন্তা করা আমার জন্য শুধু অসম্ভব নয় বরং অকল্পনীয়। কয়েকটি কারনে আমার জন্য কোন মন্তব্য করা ভালো দেখায় না। আমি এখনো ছাত্র,সুতরাং খারাপ কিছু বললে বড়দের অসম্মান করা হবে। ভালো কিছু বললে সেটা বয়স স্বল্পতার কারনে অগ্রহণযোগ্য হবে। সবগুলো মাদ্রাসা সম্বন্ধে না জেনে কিছু বলাটা অনধিকার চর্চার মত হয়ে যায়,অতএব,কোন রাস্তাই আমার কাছে নেই যে,আমি আমার মনের বাস্তব রূপ প্রকাশ করব। তবে মন এমন যে,কিছু কথা আটকে রাখতে পারে না। সবার বেলায় এমন হয়,যে সে চাইলেও কিছু কথা লুকিয়ে রাখতে পারবে না।
কাজেই আমি একটা বিষয়ের উপর আমার কিছু কথা আপনাদের জানাতে চাই,এবং আপনাদের অবস্থাও জানতে চাই। যেহেতু কদিন আগে পরীক্ষা দিলাম,তাই পরীক্ষা নিয়ে মনের কিছু আবেগ মেশানো কথা বলা আমার জন্য আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবশ্যক বললাম কেন,সেটা পরে বলছি। মাদ্রাসায় পরীক্ষা বছরে তিনবার হয়।স্কুলেও তিনবার।তবে মাদ্রাসার সাথে স্কুলের পরীক্ষার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে।
প্রথমত মাদ্রাসার কথা বলি। মাদ্রাসার পরীক্ষার স্বাভাবিক চিত্র এমন যে,আরম্ভ হওয়ার সপ্তাহ থেকে দশদিন আগে দারস-তাদরীস বন্ধ করে দেয়া হয়।ছাত্ররা প্রস্তুতির জন্য ৭থেকে১০দিন সময় পায়। উক্ত সময়ের মধ্যে ক্লাস-ভেদে কারো হয়তো স্বীয় বইয়ের ২০ পৃষ্টা পরীক্ষার পাঠ্যসূচিতে থাকে,আবার কারো ৪০০ থেকে ৬০০ পৃষ্টার বই প্রায় প্রতিদিন পরীক্ষা দিতে হয়। পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত সিলেবাস না থাকায় পূরো বই পরতে হয়।
ফলে পরীক্ষার সময় মাথায় যেন পাহাড় ভেঙ্গে পড়ে। আবার পরীক্ষার পূর্বের বন্ধ,পরীক্ষা চলাকালীন সময় এবং পরীক্ষার পর আবারও বন্ধ দেয়া মিলিয়ে প্রায় মাস-খানেক সময় লেগে যায়।
স্কুলের পরীক্ষার চিত্র হলো,ক্লাস টেন/এইট/ফাইভ এর পরীক্ষার সময় লম্বা সময় নিয়ে পরীক্ষা হয়। প্রতি বিষয়ের পর ২দিন হলেও বিশ্রামের সুযোগ দেয়া হয়। অন্যান্য শ্রেণীর পরীক্ষাতেও বিশ্রামের মোটোমোটি একটা সুযোগ থাকে। তার উপর সব ক্লাসেই পূরো বই থেকে আলাদা করে পরীক্ষার পড়াগুলো বলে দেয়া হয়।শহরেতো ছাত্র-ছাত্রীরা বছরের শুরুতেই জেনে যায় যে,কোন পরীক্ষায় কতটুকু এবং কোন কোন চ্যাপ্টার থেকে আসবে।
যার কারনে তাদের জন্য পরীক্ষা দেয়াটা মাদ্রাসার ছাত্রদের তুলনায় অনেক সহজ হয়ে যায়।
আমি মনি করি কিছু বিষয়ে বাস্তবতা চিন্তা করে উলামাদের ব্যবস্থা নেয়া উচিত। যদি এমন হয় যে,প্রতিবছর দুটো পরীক্ষা নেয়া হয়,তবে পড়ানোর জন্য একমাস সময় বাড়তি পাওয়া গেল। দারস-তাদরীস হচ্ছে আসল,পরীক্ষা তো তার ফলাফল জানার মাধ্যম। তার উপর প্রতি বছরের শুরুতে যদি পূরো বছরের সিলেবাস প্রণয়ন করে দেয়া হয়,তবে সেটা খুব বেশী ভালো কিছু না করলেও কিছু ভালো ফলাফল আসবে বলে আমার বিশ্বাস।
আমার লেখাটা মূলত যে উদ্দেশ্যে লেখা,সেটা হলো যে,আলিয়া ১ম বর্ষ থেকে দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত যেসব কিতাবাদী পড়ানো হয়,সেগুলো এক বছরে ভালভাবে আয়ত্ত করা বর্তমানের ছাত্রদের জন্য অনেক জটিল ও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের আকাবিরদের জীবনের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে,তারা আমাদের মত গৎবাঁধা নিয়মে পড়া-লেখা করে আকাবির হননি। তার উপর বর্তমান সময় বিবেচনায় ছাত্ররা দুনিয়ার কাছে নিজেদের এমনভাবে সপে দিয়েছে যে,মুখতাসারুল মাআনী থেকে বুখারী শরীফ,নফহাতুল আরব থেকে মাকামাতে হারিরী তার জন্য বোঝা মনে করতে শুরু করেছে। মিশকাত-দাওরায়ে হাদিসের কিতাবগুলো ভালোভাবে বুঝে একবছরের মধ্যে আয়ত্ত করা বর্তমানের ছাত্রদের জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কাজেই এতোসব বিষয় বিবেচনা করে যদি,সেমিস্টার পদ্ধতি চালু কারা যেত, যাতে করে ছাত্ররা কিছুটা হলেও কিতাব আগের থেকে বেশী বুঝতে পারে।
আমি আরেকটু পরিষ্কার করে বলছি, মনে করুন প্রতি বছর পরীক্ষা দুইবার অনুষ্ঠিত হবে, প্রথম পরীক্ষার পূর্বে যা পড়া হবে,সেগুলো পরবর্তী পরীক্ষায় আসবে না। কারন বেশিরভাগ ছাত্রই পরীক্ষার সময় পড়া-লেখায় মনযোগী হয়,এবং পরীক্ষার মৌসুমেই সে তার পূর্ণ পড়াগুলো ভালভাবে আয়ত্ত করে থাকে। বাস্তবতা হলো যে,যখন ছাত্ররা তাদের ৭০০থেকে৮০০ পৃষ্টার একেকটি কিতাব নিজেদের সামনে মেলে ধরে,তার মাথা এমনিতেই গুলিয়ে যায়। তখন সে বাছাই করে পড়তে আরম্ভ করে।ফলে কিতাবের উপর তার দক্ষতা অর্জিত হয় না। তবে একথা অস্বীকার করছি না যে,কিছু ছাত্র আছে,যারা সবসময় নিজেদেরকে পড়া-লেখার সাথে সম্পর্কিত রাখে,এদের কথা আলাদা।বেশিরভাগ ছাত্রই পড়া-লেখায় অমনোযোগী হয়। এখন যদি সে সামান্য করে শিখতে থাকে তবে তার জন্য অনেক সহজ হয়ে যায়।
মনে করুন প্রতিটি শ্রেণীর বইগুলো দুই অংশে ভাগ করে দেয়া হবে। প্রথম অংশ শেষ হওয়ার সাথে তার প্রথম অংশের সাথে সম্পর্ক থাকবে না,ফলে সে পরের অংশে পূর্ণ মনোযোগ দেবে। তখন তার পক্ষে বই আগের তুলনায় কিছুটা হলেও বেশী আয়ত করা সম্ভব হবে। অনেকটা প্রাইভেট কলেজ ও ভার্সিটির মত। দয়া করে কেউ এ কারনে মাদ্রাসার সম্মান কমে যাবে,এমনটি মনে করবেন না।
সেই সাথে যদি মাসে একদিন মাসিক পরীক্ষার ব্যবস্থা নেয়া যায়,তবে তো সোনায় সোহাগা। ছাত্ররা এমনিতেই পরীক্ষার ভয়ে কিতাব পরতে আগ্রহী হবে।