আজ (১৩ এপ্রিল ২০১৪) পারিবারিক একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম। খাবার পর্বে একজন আনুমানিক ৬০/৬৫ বছর বয়সী মানুষ আমাদের সাথে বসলেন। আগের-দিন এই মানুষটি আমায় পাগড়ি পরিহিত দেখেছিলেন। প্রথমেই আমাকে বললেন; পাগড়ি কোথায় হুজুর? বললাম, এই গরমে পাগড়ি পরার সাহস হয়নি। কিছুক্ষণ তিনি পাঠান ও সুদানী মানুষদের লম্বা পাগড়ি পরা নিয়ে কথা বললেন।
এই সময়ে তিনি তাঁর পরিচয়ও দিলেন। রানাপিং মাদরাসায় পড়ালেখা করাকালীন সময়ে মাওলানা বদর নামে আমাদের এক মামা পাকিস্তানে হিজরত করেছিলেন। ভালো ছাত্র হিসেবে তিনি আলেম সমাজে বেশ পরিচিত মানুষ ছিলেন। পাকিস্তানে বিয়ে করে সেখানেই জীবন যাপন শুরু করেন। কয়েক বছর পূর্বে সেখানে তাঁর ইন্তেকাল হয়েছে। সেই মামার সহপাঠী ছিলেন, তাঁর চেয়ে ভালো ছাত্র ছিলেন ইত্যাদি বিভিন্ন কথা বললেন। দাঁড়ি থাকলেও লেবাস দেখে আলেম মনে হচ্ছিলো না। জিজ্ঞেস করলাম; কোন জামাত পর্যন্ত পড়েছেন? উত্তরে বললেন; তোমাকে বলা যাবে না। তবে আমি কোথাও আটকে যাবো না।
অতঃপর কিভাবে কথার মোড় ঘুরিয়ে বললেন; আলেম উলামারা এখন ওয়াজ মাহফিল নিয়ে ব্যবসা শুরু করে দিয়েছেন। অথচ কুরআনে আছে “ وَلاَ تَشْتَرُواْ بِآيَاتِي ثَمَناً قَلِيلاً وَإِيَّايَ فَاتَّقُونِ”<এটা কি উচিৎ হচ্ছে।
বয়সে আমার বড় ভাইদের উস্তাদতুল্য হবেন। কি বলবো না বলবো, বেয়াদবি হয় কি না এসব ভেবে বললাম; আয়াতটা তো ইয়াহুদিদের ব্যাপারে অবতীর্ণ। এই আয়াত দ্বারা ওয়াজ মাহফিলে টাকা গ্রহণের ব্যাপারে কথা বলা কি যৌক্তিক হবে? বললেন; সে যাই হোক, কুরআনের আয়াতের আহকাম তো আর বাতিল হয়ে যায়নি।
তারাবী ও ওয়াজ মাহফিলের হাদিয়া গ্রহণ সম্পর্কে বেশ ঘাঁটাঘাঁটি করেছিলাম। এই প্রসঙ্গে বর্ণিত আয়াত সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা আছে। ভাবলাম, যা জানি তা বর্ণনা করি। কিন্তু বেআদবি হয় কি না ভেবে নীরব থাকলাম।
কিছুক্ষণ পর আরেক বৃদ্ধকে দেখিয়ে বললেন; উনি আমার চাচা! চাচা এতো কঠিন কঠিন প্রশ্ন করেন যে, অমুক উপজেলার কোনো আলেম তাঁর প্রশ্নের উত্তর দেবার সামর্থ্য রাখেন না। যেমন চাচার প্রশ্ন হচ্ছে; সুন্নত ২ রাকআত হওয়া উচিৎ, আমরা ৪ রাকআত পড়ি কেন! মনে মনে হাসলাম। এই উদ্ভট প্রশ্নের উত্তর তো আমিই দিতে পারবো। আর পুরো উপজেলায় নাকি একজন আলেমও নেই যিনি তাঁর চাচার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন না!!! ভাবছিলাম এখানেও কালাম করবো। বেআদবি হয়ে যায় কিনা ভেবে নীরব থাকলাম।
কিছুক্ষণ পর আবার বললেন; তুমি কি ওয়াইজ হবে? আমি বললাম; মাদরাসায় পড়ানো/ওয়াজসহ দ্বীনের জন্য প্রয়োজন এমন সব কাজই করবো ইনশাল্লাহ। বললেন; সে তো করবেই। বাবার মাদরাসা আছে না। মুখে চলে আসছিলো; শুধু বাবার মাদরাসা কেন! অন্য মাদরাসায় ও তো পড়াতে পারি। অন্য কোথাও তো ওয়াজ করতে পারি। বেআদবি হয়ে যায় কিনা ভেবে এখানেও নীরব থাকলাম।
একটু পর আরেকজন এসে জিজ্ঞেস করলেন; বাড়ির মাদরাসার মুহতামিম কে? উত্তরে আমার ভাইয়ের নাম বলে সাথে সাথে বলে উঠলেন; দাদা শুরু করেছেন, বাবা সমাপ্ত করেছেন আর তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে মাদরাসা পেয়ে গেছেন!!! ভাবলাম, এখানেও কিছু একটা বলি। কিন্তু আধবুড়ো মানুষ। বেআদবি হয় কিনা ভেবে নীরব থাকলাম।
উঠে আসার সময় আমায় বললেন; তুমি নিজের মানুষ বলে বলছি। তোমার ভেতরে ভারী কিছু নেই। আমি হাসলাম আর উঠে চলে আসলাম।
আমার ছোট্ট ভাতিজা সাথে ছিলো। বাইরে আসার পর কিছুটা রাগের সাথে বললো, তিনি ভিতরের খবর কিভাবে জানলেন! আমি বললাম, বৃদ্ধ মানুষ। বাদ দাও।
এরপর থেকে ভাবছিলাম, নীরবতা সবসময় কল্যাণ বয়ে আনে না। আমি একটু বেশিই নীরব। কেউ অকাজে গালি দিলে চুপ থাকি, কেউ সমালোচনা করলেও চুপ থাকি। কেউ অবজ্ঞা করলেও চুপ থাকি। নীতি বদলানো দরকার। এই সমাজে নিরীহ মানুষদের জন্য ভালো কিছু অপেক্ষা করছে না। ফেসবুকে প্রকাশিত