গতরাতে(বুধবার) ইন্তেকাল করেন আমার চাচাতো ভাই মুহাম্মাদ আবদুল কাইয়ুম। যিনি নিজের নাম লিখতেন “সৈয়দ আবদুল কাইয়ুম আব্বাসী”। বয়স ৫০-৫৫ হলেও চেহারায় ছিলো সদ্য চল্লিশ পেরোনো ভাব। বাবরী চুল আর মুখ-ভর্তি কালো দাঁড়িতে মোটেও বয়সের ছাপ ছিলো না।
বিগত রোববার ইন্তেকাল করেছিলেন আমার আরেক চাচাতো ভাই ক্বারি আব্দুস সালাম। তিনদিনের মধ্যে দুজন অতি আপন মানুষের মৃত্যু পরিবারের মধ্যে বিষাদের হাওয়া প্রবাহিত করে দিয়েছে।
আবদুল কাইয়ুম আব্বাসী আমাদের কাছে ছিলেন এক রহস্য মানব। বৃহত্তর সিলেটের প্রধান মুফতি, আমার উস্তায মাওলানা আবুল কালাম জাকারিয়া (দা.বা.) এর সহপাঠী এই মানুষটি মুফতি সাহেব হুজুরের চেয়েও প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন। পরীক্ষার ফলাফলেও নাকি সবসময় এগিয়ে থাকতেন। কিন্তু অদ্ভুত এক কারণে মিশকাত পর্যন্ত পড়ার পর আবদুল কাইয়ুম ভাই পড়া ছেড়ে দেন। আমি এবং আমার পূর্ববর্তীরা এই বিষয়টি ভেবে অবাক হতাম যে, এতো মেধাবী মানুষটি কেন দাওরায়ে হাদীস পড়লেন না! কারো কাছেই কোনো জবাব ছিলো না। এখনো নেই। নিজের যোগ্যতাকে কখনোই কাজে লাগাতে চেষ্টা করেননি কেন এই প্রশ্নটিও আসতো। কিন্তু উত্তর পাইনি।
পড়ালেখা সমাপ্ত না করলেও আরবি,ফার্সি,ইংরেজি,উর্দু ভাষায় তাঁর দক্ষতা সবাইকে অবাক করতো। আরবি, ফার্সি, উর্দু ভাষায় অনেক কবিতা লিখেছেন। অনর্গল ইংরেজিও বলতে পারতেন। আমার বড় ভাই আজ বললেন, আবদুল কাইয়ুম ভাই যে কোনো বিষয়ে দুই, তিন পৃষ্ঠার লম্বা কবিতা অনায়াসে লিখতে পারতেন। হাফিজ ছিলেন না। কিন্তু অনেক জায়গায় তারাবিতে হাফিজ সাহেবকে লোকমা দিতেন।
পড়া ছেড়ে দেয়ার পর থেকে প্রায় ৪০-৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত পরিবারের কারো সাথে তাঁর খুব একটা সম্পর্ক ছিলো না। সবাই মিলে অনেক চেষ্টা করেও বিয়ের জন্য তখন রাজি করানো যায়নি। নিজের ঘরে একাকী রান্না করে খেতেন। অবশেষে চল্লিশ পেরোনোর পর বিয়েতে রাজি হলেন এবং বিয়ে করলেনও। আজ দেখলাম তিনটি সন্তানের মাঝে বড় ছেলের বয়স মাত্র সাড়ে সাত।
আমি ছোটবেলায় তাঁকে বেশ ভয় পেতাম। আজ জানলাম, পরিবারের আরো অনেকেই তাঁকে ভয় পেতেন। কিন্তু ভয় পাওয়ার নির্দিষ্ট কোনো কারণ ছিলো না। একই পরিবারের সদস্য হওয়ার পরও তিনি কি করতেন, এই বিষয়টি দীর্ঘদিন পর্যন্ত কারো জানা ছিলো না। সম্ভবত এই বিষয়টি সবাইকে ভীত করে রাখতো।
বুঝতে শেখার পর বাড়িতে গেলে বুঝতাম, এই মানুষটিকে এমনি এমনি ভয় পেতাম। অথচ কতো স্নেহ করেন। বার্ষিক মাহফিলে বাড়িতে গেলে অপরিচিত অনেকের সাথে দেখা হতো। তিনি সাথে থাকাকালীন সবসময়ই আমাকে দেখিয়ে বলতে শুনেছি, আমাদের পরিবারের সবচেয়ে ছোট ভাই।
বিয়ের পর সবার সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক হয়ে যায়। ছয় বছর পূর্বে এক রমজানে বাড়িতে আমি তারাবি পড়িয়েছিলাম। তখন প্রায়ই বিভিন্ন বিষয়ে কথা হতো। কিন্তু আমার চিন্তা চেতনা এখনকার তুলনায় তখন কচি শিশুই ছিলো। সেই সময়ের ভাবনা অনুসারে তাঁকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতাম। ফলে খুব একটা কিছু তাঁর কাছ থেকে জানতে পারিনি।
গতরাতে খাওয়া দাওয়া করে ঘুমানোর মুহূর্তে আচমকা বুকে ব্যথা অনুভব করেন। স্ত্রীকে ঘরের অন্যদের সংবাদ দিতে বলার কয়েক মুহূর্ত পর সবাই পৌঁছার পূর্বেই এই দুনিয়াকে ত্যাগ করেন।
পড়ালেখা শেষ না করে একসময় ছন্নছাড়া জীবন কাঁটালেও মুফতি আবুল কালাম জাকারিয়া (দা.বা.) এর সাথে তাঁর সুসম্পর্ক সসময়ই ছিলো। আমি একদিন দেখি, মুফতি সাহেব হুজুর তাঁর দাঁড়িতে হাত দিয়ে বলছেন, তোমার এগুলো আর লম্বা হয় না কেন! তখন মুখ ভর্তি দাঁড়ি থাকলেও খাটো ছিলো। আমি তো অবাক। আমরা যাকে ভয় পেতাম, সেই মানুষটার সাথে আমাদের উস্তাযের এতো ভালো সম্পর্ক। মুফতি সাহেব জানিয়েছেন, ফোন করলে তাঁর সাথে বাংলা ছেড়ে আরবি ভাষায় কথা বলতেন। সেই মায়ার টানেই আজ হুজুরও গিয়েছিলেন। সবার অনুরোধে জানাযার নামাজ পড়িয়েছেন। অতঃপর পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়েছে।
আমার ভাগ্য বলতে হয়। আজ হিদায়া ৩য় খণ্ডের পরীক্ষা ছিলো। আমার লেখার হাত খারাপ। তবুও দ্রুত লিখে ১২;৪০ এর দিকে হল থেকে বেরিয়ে তৎক্ষণাৎ গাড়ী নিয়ে যোহরের নামাজের শেষ মুহূর্তে বাড়িতে পৌঁছে জানাযা, দাফনে অংশ নেই। না গেলে বেশ খারাপ লাগতো সন্দেহ নেই।
ভালোমন্দের মিশ্রণে মানব। অনেক ভালোর মাঝে খারাপ একটি দিক ছিলো, একাকী জীবন যাপনের সময় পার্শ্ববর্তী মাদরাসার আসাতিযাদের বিভিন্ন সময় হয়রানি করতেন। তাঁর মেধার সামনে সবাইকে চুপসে রাখতেন। তাঁর জীবনটাই ছিলো সবার চোখের আড়ালে। ফলে ইচ্ছে থাকলেও অনেক কিছু জানা হয়নি।
রোববার ক্বারি সালাম ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদ শুনে কষ্ট পেয়েছিলাম। আবদুল কাইয়ুম ভাইয়ের মৃত্যুতে সেই কষ্ট বহুগুণ বেড়ে গেলো। চোখে পানি নেই। চেহারা স্বাভাবিক। কিন্তু অন্তরে অদ্ভুত এক শূন্যতা অনুভব করছি। সম্ভবত এই শূন্যতা শুধু আমাকে নয়, পরিবারের আরো অনেককে স্পর্শ করেছে……… ফেসবুকে প্রকাশিত