১) ইজতেমায় যাবো কি যাবো না নিশ্চিত ছিলাম না। কখনো মনে হচ্ছিলো, যাবো। কখনো আবার ভাবছিলাম, নাহ! এতো কাজ ফেলে যাওয়া সম্ভব হবে না। শেষ পর্যন্ত ২২ জানুয়ারি বুধবার নিশ্চিত হলাম যে, আমি বৃহস্পতিবার ইজতেমায় যাচ্ছি। কিন্তু সমস্যা বাঁধলো অন্য জায়গায়। প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার মাদরাসায় ছাত্রদের মেধা বিকাশের লক্ষ্যে সাপ্তাহিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ২৩ জানুয়ারি বৃহস্পতিবারের সভা উপস্থাপনার দায়িত্ব ছিলো আমার। ইজতেমায় যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হবার পর বুধবার ক্লাসে গিয়ে (আমার চেয়ে অনেক ভালো উপস্থাপক) এক সহপাঠীকে আমার বদলে উপস্থাপনার অনুরোধ করতেই রাজি হয়ে গেলো। অতঃপর আমার ইজতেমায় যাওয়া এবং অন্যজনের উপস্থাপনার বিষয়টি চলতি সভায় সভাপতির দায়িত্বপ্রাপ্ত উস্তাযকে জানাতেই কিছুটা রাগ করলেন। অবশেষে তিনি শর্ত দিলেন; কিছু সময় আমি উপস্থাপনা করার পর ছুটি নিয়ে যেতে পারবো।
মাদরাসা থেকে নির্ধারিত জামাত বুধবার রাতেই চলে গিয়েছিলো। আমি একাকী যাবার বদলে জামেয়া কৌড়িয়া মাদরাসার কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গী হলাম। তাঁদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে ঠিক হলো, বৃহস্পতিবার বিকেলের গাড়ীতে আমরা যাত্রা করবো। সাপ্তাহিক সভায় উপস্থিত থাকার পর সময় মতো যাওয়া নিয়ে কিছুটা চিন্তিত হলেও আল্লাহ্ তায়ালা সাহায্য করবেন এই বিশ্বাস ভেতরে ছিলো।
বৃহস্পতিবার দুপুর ১:১৫ ‘র দিকে মাদরাসা ছুটি হয়ে গেলো। কিন্তু আমি ২:৩০ পর্যন্ত সাপ্তাহিক সভার অপেক্ষায় বসে রইলাম। অবশেষে নির্ধারিত সময়ে সভা শুরু হলো। প্রায় ৩:০০ ঘটিকার সময় উস্তাযে মুহতারামের অনুমতি নিয়ে সভা থেকে চলে আসলাম।
ঘরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিলো। সবকাজ শেষ করে বাসায় আসতে আসতে প্রায় ৪:০০ টা পেরিয়ে গেলো। বাসার কাছে আসতেই ভ্রমণ সঙ্গীদের ফোন পেলাম যে, তাঁরা সিলেটের কাছাকাছি চলে এসেছেন। আমার তখনো চুল কাঁটা, নখ কাঁটা, গোসল, প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র দিয়ে ব্যাগ গোছানো, দুপুরের খাবার বাকি।
চুল কাঁটার পরিকল্পনা ত্যাগ করলাম। তড়িঘড়ি করে নখ কেটে গোসল করলাম। একদিকে জিনিষপত্র ঠিক করালাম অন্যদিকে সময়ের অভাবে আম্মু ভাত খাইয়ে দিলেন।
৫:১৫ মিনিটের দিকে ভ্রমণসঙ্গী কোড়িয়া মাদরাসার ছাত্র আবুল কালাম ভাই ফোন দিয়ে বললেন, ৫:৩০ এর সময় আমাদের গাড়ী ছাড়বে। তাড়াতাড়ি করে যেন টার্মিনাল চলে আসি।
জ্যাম না হলে আমাদের বাসা থেকে টার্মিনাল যেতে কম করে হলেও ৩০ মিনিট লাগে। তাঁকে বললাম, আমাদের আসতে ৫/১০ মিনিট দেরি হতে পারে। তাঁরা যেন গাড়িকে আটকে রাখেন। অতঃপর ৩/৪ মিনিটের মধ্যে আমি ও আমার ভাতিজা শরীফ মাহমূদ বাসা থেকে বেরুলাম। CNG খুঁজছিলাম, এমতাবস্থায় পরিচিত এক অটো ড্রাইভার এসে তার গাড়ীতে করে যাওয়ার অনুরোধ করলো। রাজি হয়ে গাড়ীতে উঠলাম। শহরের বিভিন্ন চিপা গলি দিয়ে আমাদের অটো এগিয়ে চললো। অর্ধপথও যাওয়া হয়নি টার্মিনাল থেকে সঙ্গীরা ফোন দিয়ে বললো, গাড়ী ছেড়ে দেবার সময় হয়ে গেছে। আর কতক্ষণ লাগবে। এভাবে ৪/৫ মিনিট পরপর ফোনে যোগাযোগ হচ্ছিলো। প্রায় ৫ মিনিট দূরত্বে থাকতে মনে হলো, সম্ভবত গাড়ী আমাদের ফেলে চলে যাবে। ৫০ টাকা দান করার মানত করলাম। বুকের ভেতর তখন রীতিমতো ভূমিকম্প হচ্ছিলো। একদিকে গাড়ী ছুটে যাওয়ার ভয় অন্যদিকে সাধারণ যাত্রী কর্তৃক সঙ্গীদের নাজেহাল হবার লজ্জা।
অবশেষে টার্মিনালের নির্ধারিত বাস কাউন্টারে আসলাম। অটো থেকে নেমেই বাসে উঠলাম। ১ মিনিটের ভেতরে গাড়ী ছেড়ে দিলো। ঘড়িতে দেখি তখন ৫:৫০ হয়ে গেছে!!!
২) বৃহস্পতিবার (২৪ জানুয়ারি) রাত ২:৩০ এর দিকে ইজতেমার মাঠে পৌঁছুলাম। যাওয়ার পূর্বে অনেকের সাথে যোগাযোগ হয়েছিলো। মাদরাসার এক সাথী আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো। রাত ১:০০ ঘটিকায় তাঁর সাথে আমার সর্বশেষ যোগাযোগ হয়। টঙ্গি যাওয়ার পর থেকেই ফোন করতে থাকলাম। কিন্তু সে তখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘুমিয়ে পড়েছে। ভাগ্য ভালো বলতে হয়। দূরসম্পর্কের এক খালুকে ফোন দিতেই পেয়ে গেলাম। একটু বাইরে এসে আমাদের নিয়ে গেলেন। ভ্রমণ সঙ্গীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি খালুর সাথে চললাম। নির্ধারিত জায়গায় যাওয়ার পর খালু আমার বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিলেন। শেষ রাতে আমায় ডেকে দেয়ার অনুরোধ করে সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়লাম।
রাত ৪:০০ টার সময় খালুর মৃদু আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। এখনি উঠতে চাই কিনা জানতে চাইলেন। ঘণ্টা-খানেক ঘুমের ফলে শারীরিক ক্লান্তি না থাকায় তৎক্ষণাৎ উঠে বসলাম। সময়ের সাথে সাথে মানুষের ঢল বাড়বে ভেবে কয়েক মিনিটের মধ্যে অজু করতে বেরুলাম। অজুর নির্ধারিত স্থানে পৌঁছার পর খালু হাউজ থেকে একটা লোটায় পানি ভর্তি করে দিলে আমি সেখানেই অজু করতে বসলাম। অজু চলাকালীন সময়ে আচমকা শার্ট পরিহিত এক ব্যক্তি পানি সংগ্রহের জন্য আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।
আমি হাত ধোঁয়ার সময় সামান্য পানি সম্ভবত লোকটার পায়ে লেগেছিলো। সাথে সাথে বলে উঠলো; গায়ে পানি পড়ছে, দেখছেন না!!! অথচ লোকটা একেবারে আমার সামনে না দাঁড়ালে পানি গায়ে লাগতো না। তবে আমি কথার জবাবে কিছু না বলে একটু সরে বসলাম আর মনে মনে বললাম; তবুও তুমি খুশি থাকো।
(৩) ফজরের নামাজের পর বিছানার উপর বসে আছি। বিভিন্ন প্রয়োজনে লোকজন আমার বিছানা ডিঙ্গিয়ে যাচ্ছিলো। ভাবলাম একটু জরিপ করে দেখি তো সাধারণের সাথে আমাদের পার্থক্য আছে কি না। ইচ্ছে করে সাথে থাকা বড় একটা তোয়ালে বিছানায় রেখে আমি বসে আছি। ইজতেমায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি মাদরাসার ছাত্র শিক্ষকদের বড় একটি দল অংশ নেয়। এতো লোকের যাতায়াতের পথে আমি দেখতে চাইছিলাম, কারা তোয়ালের উপর পা দিয়ে আর কারা ভালোমতো দেখে পার্শ্ব পথে যায়।
বলতে লজ্জা নেই; পাঞ্জাবী টুপি পরিহিত অনেকেই তোয়ালের উপর দিয়ে এমনভাবে অতিক্রম করলেন, মনে হলো যেন পাপোশের উপর দিয়ে চলছেন। অন্যদিকে অনেক সাধারণ মানুষ সাইড কেটে গেলেন। নিজেদের অসচেতন মনোভাব আবারো উপলব্ধ হলো।
>ইজতেমার বিশেষ নোটবুক থেকে…… ফেসবুকে প্রকাশিত