“প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও গরু কুরবানী করতে নিষেধ করে তাদেরকে খাঁটি হিন্দু হিসেবে প্রমাণ করলো দেওবন্দীরা” শিরোনামে দস্তার রাজদরবার নামে একজনের একটি লেখা চোখে পড়লো।(দেখতে চাইলে ক্লিক করুন)> লেখার ভঙ্গিমা চমৎকার হলেও অপ্রতুল জ্ঞান ও অজ্ঞতার কারণে লেখক অপব্যাখ্যা করেছেন। আসুন পুরো লেখাটা পড়ে সত্য মিথ্যা বিবেচনা করি।
ভূমিকা : ভারত হিন্দু প্রধান রাষ্ট্র। মুসলমানরা জিন্নাহ’র নেতৃত্বে ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। যদিও স্বাধীনতার পূর্বে হিন্দু নেতৃবৃন্দ মাওলানা মাদানির অখণ্ড ভারত ফর্মুলার পক্ষে ছিলেন বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। দেশভাগের ফলে ভারতে হিন্দুদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। মুসলমানদের পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তান হলেও মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী ও আবুল কালাম আযাদের উপর আস্থাশীল কিছুসংখ্যক মুসলমান ৪৭ সালে ভারতে নিজেদের অবস্থান অক্ষুণ্ণ রাখেন। তাঁদের এই ত্যাগ তিতিক্ষার ফলে রাষ্ট্র ধর্ম হিন্দু হওয়ার বদলে ধর্ম নিরপেক্ষতার উপর ভারতের ভিত্তি স্থাপিত হয়। উইকিপিডিয়ায় প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, ভারতে মুসলমানদের সংখ্যা মাত্র ১৩.৪%। অন্যদিকে হিন্দু জনগোষ্ঠী ৮০.৫%। (এখানে ক্লিক করুন)
(১)
ইসলাম ধর্মের বিঁধান অনুযায়ী প্রাপ্তবয়স্ক,বুদ্ধিমান,নিজ গৃহে অবস্থানকারী(মুসাফির নয় এমন) ব্যক্তি যদি ১০ই যিলহজ্জ ফজর হতে ১২ই যিলহজ্জ সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় তবে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। কুরবানির পশু ছয় প্রকার : উট,গরু,ছাগল,দুম্বা,ভেড়া,মহিষ। এ সমস্ত পশু ব্যতীত অন্য পশু কুরবানী জায়িয নেই। উল্লিখিত ছয় প্রকারের যেকোনো একটি দিয়ে কোরবানী দিলে আদায় হয়ে যাবে।
সুতরাং সুস্পষ্ট হয়ে গেলো কোরবানী ওয়াজিব, তবে উক্ত ছয় প্রকারের যে কোনো একটি দিয়ে আদায় করলেই চলবে। কেবল উট দিয়ে করতে হবে এমনটি নয়। গরু ছাড়া কোরবানী হবে না এমনটিও ইসলামের দাবী নয়।
(২)
গুরুত্বপূর্ণ চারটি পয়েন্ট>
>বিধর্মী রাষ্ট্রের কোনো আইন যদি ইসলামের মৌলিক আদর্শের বিরোধী না হয়, তবে রাষ্ট্রীয় আইন হিসেবে সেই আইন মেনে চলা প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব। বিধর্মী রাষ্ট্রের আইন যখন ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক হবে তখন ক্ষমতা থাকলে প্রতিবাদ নয়তো দেশ ত্যাগ করে মুসলিম রাষ্ট্রে চলে যাওয়ার বিঁধান।
>ইসলাম পৃথিবীর একমাত্র সত্য ধর্ম। কিন্তু যারা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী নয় তাদের কাছে এই সত্যটুকু সুস্পষ্ট নয়। যেমন ভারতের ৮০.৫% হিন্দু জনগোষ্ঠীর কাছে মুসলমানগণ প্রতিপক্ষ হিসেবে পরিচিত। তাদের কাছে সদ্ব্যবহার আশা অর্থহীন।
>মূর্খ হিন্দুরা ৩৩ কোটি দেবতায় বিশ্বাসী। আর তাদের দেবতা শ্রী কৃষ্ণ গাভীর দুধ খেত, তাই তারা গরু কে বা গাভীকে মা বলে ডাকে।
>আমাদের দেশের আওয়ামী-বিএনপির মতো ভারতে দীর্ঘদিন থেকেই বিজেপি বা কংগ্রেস শাসন করে আসছে। আমাদের কাছে যেভাবে আওয়ামীলীগ কট্টরপন্থী এবং বিএনপি উদারপন্থী হিসেবে পরিচিত; ভারতেও বিজেপি কট্টর এবং কংগ্রেস উদারপন্থী হিসেবে পরিচিত। বিজেপি হিন্দুবাদী ফ্যাসিস্ট দল। হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির জন্য সবসময়ই তারা তৎপর। ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদ ধ্বংসের পিছনেও বিজেপি দায়ী।
(৩)
দারুল উলূম দেওবন্দ শুধু ভারত নয়, পুরো উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করছে। দেওবন্দের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসই এর প্রমাণ। দারুল উলূম দেওবন্দের নিজস্ব ওয়েবসাইট রয়েছে। (দারুল উলূম দেওবন্দের ওয়েবসাইট) যেখানে দেওবন্দের বিবৃতি প্রচারিত হয়ে থাকে। কিন্তু লেখক সেই ওয়েবসাইটের বদলে একটি অখ্যাত অনলাইন পত্রিকার রেফারেন্স উল্লেখ করেছেন (এখানে ক্লিক করুন)। নামের ফলে মিডিয়া সন্ত্রাসের এই সোনালী যুগে সংবাদটি কতোটুকু সত্য প্রশ্ন থেকেই যায়। তবুও যদি সংবাদটি সত্য বলে মেনে নেই, তবে প্রশ্ন থেকে যায়> দেওবন্দ কর্তৃপক্ষের জন্য এমনটি করা কি উচিত হয়েছে?
>যেহেতু একটি গোষ্ঠী সবসময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির মাধ্যমে ভারতকে মুসলমান শূন্য করতে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে; এমতাবস্থায় হিন্দুদের প্রাধান্য রয়েছে এমন এলাকায় যে কোনো ছোটখাট ইস্যুতে মুসলমানদের উপর অত্যাচার করার সুযোগ চলে আসছে। আর কেন তারা অত্যাচার করবে এই প্রশ্ন রাখাও অবান্তর। কেননা যাঁদের সবকিছুই মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত তাদের কাছে কেন প্রশ্নের উত্তর খোঁজাটা নিশ্চয় যৌক্তিক নয়।
আর গরু জবাইকে কেন্দ্র করে উগ্র হিন্দুরা মুসলমানদের আক্রমণ করে বসলে ১৩.৪% মুসলমানদের পক্ষে তাদের প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। ফলে নিজেদের স্বার্থেই সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরী।
>কোরবানী ওয়াজিব হলেও গরু কোরবানী ওয়াজিব নয়। ছয় প্রকারের যে কোনো একটি দিয়ে কোরবানী আদায় হয়ে যায়। খোদ রাসূল (সা:) ভেড়া কোরবানী করেছিলেন।
>গরু কে হিন্দুরা যেহেতু সম্মানের চোখে দেখে, আর মুসলমানদের জন্য গরু ব্যতীত অন্যান্য প্রাণী দিয়ে কোরবানির সুযোগ রয়েছে। এমতাবস্থায় গরু ব্যতীত অন্য প্রাণী দিয়ে কোরবানির আহ্বান হিন্দু নয় মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার্থেই যে করা হয়েছে এটুকু বুঝতে অন্তত মহাজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই।
(৪)
দস্তার রাজদরবার বলেছেন ’’দেওবন্দী ধর্মব্যবসায়ী মাওলানারা বারবার গরু কুরবানী করতে নিষেধ করেছে হিন্দুদের দেবতা অজুহাতে, ভারতীয় মুশরিক সরকারের নিষেধাজ্ঞার অজুহাতে ও হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার দোহাই দিয়ে। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রশ্ন হলো- তাহলে কি মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতি বা সম্মান নেই দেওবন্দী কওমী খারিজীদের কাছে? গরু কুরবানী করতে নিষেধ করায় তো মুসলমানরা কষ্ট পায় ধর্ম পালন করতে না পারায়। আসলে দেওবন্দীরা মুসলমানদেরকে গরু কুরবানী করতে নিষেধ করে তারা তাদেরকে খাঁটি হিন্দু হিসেবে প্রমাণ করছে।’’
কথাগুলো লেখকের অজ্ঞতাকেই প্রকাশ করেছে। ভারতে মুসলমান জনগোষ্ঠী সংখ্যালঘু। কিন্তু রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রয়েছে তাদের পূর্ণ অধিকার। ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম মুসলমান ঘরের সন্তান। ভারতের বর্তমান উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারিও মুসলমান। (যদিও কেউই ধার্মিক নন)
পুরো ভারতজুড়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে গরু কোরবানী নিষিদ্ধও নয়। (http://en.wikipedia.org/wiki/Cattle_slaughter_in_India) বরং প্রাদেশিক আইনে কোথাও কোথাও যেমন : বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশে গরু জবাই নিষিদ্ধ। (http://forum.projanmo.com/topic33136.html) আর সংখ্যালঘু বিধায় এই আইন বদলানোর ক্ষমতাও মুসলমানদের হাতে নেই। আর এটি ইসলামের মৌলিক বিধানের সাথে সাংঘর্ষিকও নয়। এখন যদি দেওবন্দ গরু কোরবানী দিতে নিষেধ করে তবে ত্রুটিটা কোথায়? আর স্বার্থরক্ষা কার হচ্ছে এর স্বপক্ষে লেখকের যুক্তিও থাকা উচিত ছিলো। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, লেখক একটি যুক্তিও উপস্থাপন করেননি।
(৫)
চলুন একটু ভিন্নভাবে ভেবে দেখি> (লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি)যদি দেওবন্দ গরু কোরবানিকে নিষেধ করতো না। ফলে মুসলমানরা যেখানে সেখানে গরু কোরবানী করতেন। এই কোরবানিকে কেন্দ্র করে হিন্দুরা মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো। সংখ্যালঘু মুসলমানগণ হিন্দুদের হাতে অত্যাচারিত হতেন। (সম্ভবত লেখক এতে খুশি হতেন)
(আমাদের ভাবনা)দেওবন্দের আহবানে কট্টর হিন্দুদের এলাকায় মুসলমানরা গরুর বদলে উট, ছাগল, ভেড়া কোরবানী করেন। তাঁদের কোরবানী আদায় হয়। হিন্দুরা মুসলমানদের উপর আক্রমণের ইস্যু পায় না। মুসলমানরা সুখে শান্তিতে বসবাস করেন।
এখন আপনি কোন পথে হাঁটবেন আপনার হাতে। শুধু একটু ভাবুন> অতঃপর পক্ষাবলম্বণ করুন। ফেসবুকে প্রকাশিত