কওম শব্দের অর্থ জাতি এবং মাদরাসা অর্থ বিদ্যালয়। কওমী মাদরাসার সহজ অর্থ দাঁড়ায় >জনগণের দ্বারা পরিচালিত বিদ্যালয়।
বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত কওমী মাদরাসা নিয়ে সুশীল সমাজের ভাবনার অন্ত নেই! যদিও সততার বদলে ধর্ম বিদ্বেষই যে, এর পিছনে কাটি নাড়ছে তা পুরোপুরি স্পষ্ট। মাদরাসা শিক্ষা সম্পর্কে কোনরূপ ধারণা ছাড়াই কওমী মাদরাসা সম্পর্কে সমালোচনাই এই শ্রেণীর দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ মানুষ কেন মাদরাসায় চাঁদা প্রদান করে/মাদ্রাসাওয়ালারা কেন গ্রহণ করে এই নিয়েও তাদের দুঃখের অন্ত নেই। আসুন, জেনে নেই কেন মাদরাসাগুলোতে চাঁদা গ্রহণ করা হয়।
(১)
ইসলামের সূচনা থেকেই একদল মানুষকে আল্লাহ্ তায়ালা ধর্মীয় বিধি-বিধান সংরক্ষণের জন্য নির্বাচিত করেছেন। যার ফলে মুহাম্মদ (সা:) থেকে প্রাপ্ত কুরআন ও হাদীস ১৪০০ বছর পরও আজ পর্যন্ত হুবহু সংরক্ষিত।
ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা লাভের পর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র পরিচালিত হতো। শিক্ষার মূল ভিত্তিটা ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিলো। ফলে তখন আরব,আফ্রিকা,এশিয়া সহ সর্বত্র কুরআন ও হাদিসের চর্চাই প্রথম শ্রেণীর শিক্ষা হিসেবে বিবেচিত হতো।
মুগল শাসন পর্যন্ত উপমহাদেশেও রাষ্ট্রীয় শিক্ষা ব্যবস্থা ধর্মের রূপরেখা অনুযায়ী পরিচালিত হতো। বিজ্ঞান সহ সবকিছুর চর্চা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় হতো। তথাপি ধর্মীয় শিক্ষাই ছিলো প্রধান। আর ইতিহাস সাক্ষী, তখনকার মানুষেরা বর্তমানের চেয়ে অনেক সভ্য এবং আনন্দে ছিলো।
(২)
ব্রিটিশ বেনিয়ারা উপমহাদেশ দখলের পর ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি বন্ধ করে শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে। মাদ্রাসাগুলোকে জ্বালিয়ে দেয়া, ঘোড়ার আস্তাবল সহ নানাকাজে ব্যবহার করা শুরু করে। জনগণকে ইসলামী আদর্শ থেকে দূরে সরিয়ে নিতে তৎকালীন বিজ্ঞ আলেমগণকে নির্বিচারে হত্যা করে। অতঃপর মুসলমানদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও কুরআন, হাদিসের শিক্ষা সংরক্ষণ এবং ব্রিটিশ বেনিয়াদের হাত থেকে দেশ ও জনতাকে রক্ষা করার মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে মাওলানা কাসিম নানুতবী মাদরাসা পরিচালনার আঁটটি মূলনীতিকে সামনে রেখে ভারতের উত্তর প্রদেশে ১৮৬৬ সনে প্রতিষ্ঠা করেন উপমহাদেশের প্রথম কওমী মাদরাসা “দারুল উলূম দেওবন্দ”। সেই আঁটটি মূলনীতি কওমী মাদ্রাসাসমূহে “উসূলে হাশ্তাগানা” বা অষ্ট মূলনীতি হিসেবে পরিচিত।
সেই মূলনীতির একটি ধারা হলো> ধর্মীয় শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত কওমী মাদরাসার জন্য স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না। কারণ, ব্রিটিশদের কূটনীতির ফসল জেনারেল শিক্ষার প্রভাবে সাধারণ জনগণ ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পথে। এখন সাধারণ জনতাকে ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত রাখার একমাত্র পন্থা হচ্ছে, তাঁদেরকে যেকোনোভাবে মাদরাসার সাথে জড়িত রাখা। আর ইসলামী শাসন ব্যবস্থা না থাকার কারণে ইসলামী তাহযীব তামাদ্দুন তথা কুরআন ও হাদীস সংরক্ষণের দায়িত্বও সমগ্র মুসলমানের উপর বর্তেছে। তাই মাদরাসা পরিচালনায় তাদের সহযোগিতা অনুগ্রহ নয় বরং দায়িত্ব আদায়। অতএব যদি কওমী মাদরাসা স্থায়ী আয় ব্যবস্থা অবলম্বন করে, তবে কুরআন হাদীস সংরক্ষিত হলেও সাধারণ জনগণ ধর্মীয় পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। কিন্তু যদি কোনোভাবে সাধারণ জনতার সাথে সম্পর্ক বহাল থাকে, তবে নিঃসন্দেহে ধর্মের ছোঁয়ায় সাধারণেরা প্রভাবিত হবে।
১৮৬৬ সালের সেই মূলনীতির কারণেই কওমী মাদরাসা সরকারি সহায়তার বদলে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। আর সন্দেহ নেই কাসিম নানুতবীর সেই মূলনীতিই আমাদের ধর্মীয় মানসিকতায় প্রতিপালিত হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
(৩)
একটু ভাবুন তো, কওমী মাদরাসা যারা পরিচালনা করেন, তাঁরা কি পারতেন না, মাদরাসায় পড়ালেখার বদলে স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিতে পড়ালেখা করতে? সরকারি সহায়তা গ্রহণ করতে? মেধার প্রশ্নে আপনি যাচাই করে দেখুন> অবাক করার মতো প্রতিভাবান মানুষেরা মাদরাসায় পড়ালেখা করেছেন। তাঁরা কি কষ্ট-মাখা (যদিও বাস্তবিক মাদরাসা পড়ুয়ারাই সুখে থাকেন বলে আমার ধারণা) জীবন ত্যাগ করে তথাকথিত সুখের পিছনে ছুটতে পারতেন না? সবকিছুই সম্ভব ছিলো। কিন্তু পরার্থে নিজেদের উৎসর্গ করে দিয়েছেন তাঁরা।
দেশের ৯০%+ মসজিদের ইমাম কওমী মাদরাসায় পড়েছেন। যারা মানুষকে সহজভাবে ধর্মীয় বিঁধান আদায়ের সুযোগ করে দিচ্ছেন। কুরআন ও হাদিসের বর্ণনা দ্বারা সঠিক পথের সন্ধান দিচ্ছেন। যদি আজ সাধারণ জনতা আর মাদরাসা পড়ুয়াদের সম্পর্ক না থাকতো, তবে কিভাবে ধর্মের বিধি বিধানগুলো সবাই জানতে পারতো?
কওমী মাদরাসায় পড়ুয়ারা ইসলামী আদর্শ বুকে লালন করে বলেই কখনো কওমী মাদরাসায় খুনোখুনি হয় না। শিক্ষকদেরকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয় না। ইভ টিজিং এর দায়ে মাদরাসা ছাত্রকে কান ধরে উঠবস করতে হয় না।
জেনারেল শিক্ষা মানেই খারাপ এমনটি কখনোই নয়। ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি জেনারেল শিক্ষা অবশ্যই প্রয়োজন। তবে মাদরাসা পড়ুয়ারা নিজেদের যেভাবে সৎ মানব হিসেবে গড়ে তুলে তাতে প্রমাণ হয় ধর্মের আদলে গড়া শিক্ষাব্যবস্থাই কেবল উন্নত জাতি গঠন করতে পারে। > লেখক : নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। ফেসবুকে প্রকাশিত ইস্টিশন ব্লগে প্রকাশিত