বাদশাহ’র মহলে এক জাদুকর বাস করতো। সে ভাবতে লাগলো, এক নিঃস্ব যুবক রাতের মধ্যে কিভাবে এতো সম্পদশালী হয়ে উঠলো। স্বর্ণের মহল বানিয়ে ফেললো। রহস্য জানার জন্য সে উদগ্রীব হয়ে উঠলো। একসময় কুশল বিনিময়ের উদ্দেশ্যে রাজকন্যার সাথে সাক্ষাত করতে মহলে আসলো এবং বিভিন্ন কথার মাধ্যমে তাকে রাজি করালো যে, সে তার স্বামীর কাছ থেকে যেকোনোভাবে রহস্য সম্পর্কে জানবে।
পরদিন রাজকন্যা তার স্বামীকে পীড়াপীড়ি শুরু করলে যুবক বললো; আমার কাছে একটি জাদুর পাথর রয়েছে। পাথরের সাহায্যে যে কোনো কিছু চাইলেই অর্জন করতে পারি। তুমি এই জাদুর পাথর কোথায় রাখো> রাজকন্যা প্রশ্ন করলো। যুবক বললো; আমি এটি আমার মুখে জিহ্বার নিচে লুকিয়ে রাখি।
পরদিন শাহজাদী এসব কথাবার্তা জাদুকরকে বলে দিলো। ঐদিন রাতে যুবক যখন গভীর ঘুমে, জাদুকর এসে মুখ থেকে পাথরটি বের করে নিলো এবং পাথরকে নির্দেশ দিলো; হে জাদুর পাথর! স্বর্ণের প্রাসাদকে শাহজাদিসহ বাদশাহ’র মহলে নিয়ে যাও। আর যুবক প্রথমে যেখানে বাস করতো, সেখানে পৌঁছে দাও।
মুহূর্তের মধ্যে স্বর্ণের প্রাসাদ বাদশাহ’র বাগানে স্থানান্তরিত হলো। যুবকের ঘুম ভাঙতেই দেখলো, সে মহলে নেই। শাহজাদিও পাশে নেই। আগের সেই মাটির ঘরে সে পড়ে আছে। পাশে তার মা বসে আছেন। এক কোনে বসে কুকুর,বিড়াল আর ইঁদুর তার দিকে তাকিয়ে আছে। হায় আমার ভাগ্য! যুবক অসহায় স্বরে বললো। জাদুর পাথর হারিয়ে গেছে। এখন আমি কি করবো! এসব বলতে বলতে সে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগলো।
যুবকের অবস্থা দেখে কুকুর,বিড়াল আর ইঁদুরের অন্তরে দয়া জাগ্রত হলো। তাদের প্রত্যেকেই মনে মনে ভাবতে লাগলো এখন কি করা যায়! তারা ভাবছিলো এমতাবস্থায় কুকুর ভেউ ভেউ করতে শুরু করলো। বিড়াল মিউ মিউ করলো আর ইঁদুর চি: চি: করতে লাগলো। অতঃপর সবাই দৌড়ে কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে গেলো।
প্রাসাদের কাছে পৌঁছে কুকুর,বিড়াল আর ইঁদুর ঘরে প্রবেশের জন্য ছিদ্রের সন্ধান করতে লাগলো। কিন্তু কোনো ফাঁকফোকর না মেলাতে তারা ৩ জন দরজার বাইরে ছিদ্র করতে শুরু করলো। প্রথমে ইঁদুর তার দাঁতকে কাজে লাগালো। এরপরে বিড়াল আরো কিছু কাজ করলো। সর্বশেষ কুকুর কাজ সমাপ্ত করলো। অল্পসময়েই এভাবে সুড়ঙ্গ তৈরি হয়ে গেলো।
প্রথমে ইঁদুর গুপ্ত পথে গৃহে প্রবেশ করলো। এরপর বিড়াল ভিতরে গেলো আর কুকুর বাইরে দাঁড়িয়ে পাহারা দিতে লাগলো।
মহলের ভিতরে প্রবেশ করেই ইঁদুর আর বিড়াল দৌড়ুতে লাগলো। খুঁজতে খুঁজতে একসময় তারা সেই রুমে পৌঁছে গেলো, যেখানে শাহজাদী বিশ্রাম নিচ্ছিলো। পাশে জাদুকরও বিশ্রাম করছিলো। জাদুকর তার ঠোট শক্ত করে বন্ধ করে রাখতে চেষ্টা করছিলো। বুদ্ধিমান ইঁদুর বুঝতে পারলো; জাদুকর জাদুর পাথর তার মুখে লুকিয়ে রেখেছে। ইঁদুর ধীরে ধীরে জাদুকরের কাছে পৌঁছে গেলো এবং তার লেজ দিয়ে নাকে সুড়সুড়ি দিতে শুরু করলো। সুড়সুড়ির কারণে আচমকা জাদুকর হাঁচি দিলো আর অমনি তার মুখ থেকে জাদুর পাথর বের হয়ে ছিটকে পড়লো। সাথে সাথে বিড়াল পাথরটি তার মুখে রেখে দিলো। অতঃপর জাদুকর কিছু বুঝতে পারার পূর্বেই তারা দুজন দ্রুতগতিতে সুড়ঙ্গের মুখে এসে পৌছুলো। কুকুর সেখানে তাদের অপেক্ষা করছিলো। বের হতেই বিড়াল মুখ থেকে পাথর বের করলো। সাথে সাথে কুকুর তার মুখে পাথর লুকিয়ে ফেললো। এরপর তারা একত্রে পলায়ন শুরু করলো।
ওদিকে মহলে শোরগোল শুরু হয়ে গেলো। চারিদিকে কেবল “ধরো ধরো” আওয়াজ শুরু হলো। সবাই চোরকে খুঁজছিলো। কিন্তু কেউ তো জানে না যে, পাথর তখন কুকুরের মুখে নিরাপদে রয়েছে।
কুকুর,বিড়াল আর ইঁদুর দৌড়তে দৌড়তে নদীর তীরে উপস্থিত হলো। এখন পাথর নদীর ওপারে কে নিয়ে যাবে এই নিয়ে তাদের মাঝে শুরু হলো বিতর্ক। বিড়াল বললো; আমি ওপারে পাথর নিয়ে যাবো। কুকুর বললো; না। এ হতে পারে না। তোমরা তো সাতারই জানো না। কিভাবে পাথর নিয়ে যাবে। পাথর নিতে গিয়ে ডুবে মরবে। ইঁদুরেরও ইচ্ছা ছিলো, সে পাথর নিয়ে ওপারে যাবে।
তিনজন অনেক্ষণ যাবত এই নিয়ে বিতর্ক করলো। কুকুর তার কথায় অনড় অবস্থান নিলো এবং তিনজন সাতার শুরু করলো। আচমকা কুকুর পানিতে তার চেহারা দেখতে পেয়ে ভাবলো অন্য কোনো কুকুর চলে এসেছে। জোর আওয়াজে যেই ভেউ ভেউ করলো অমনি জাদুর পাথর তার মুখ থেকে পানিতে পড়ে গেলো। সাথে সাথে একটি বড় মাছ পাথরটি গিলে ফেললো।
আমি কি বলিনি যে, তুমি পাথর নিয়ে যেয়ো না। বিড়াল হতাশ ভঙ্গিতে বলে উঠলো। তিনজনই তখন চিন্তিত। কি করা যায় ভাবতে লাগলো। স্বীয় মালিকের কাছে পাথর না নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে পারছিলো না। কাছেই জেলেদের একটি পল্লী ছিলো। তারা অস্থির অবস্থায় ঐ বস্তিতে গেলো। তিনজনই ছিলো প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত।
সৌভাগ্যক্রমে এক জেলে একটি বড় মাছ ধরলো। সে মাছটি কেটে নাড়িভুঁড়ি ফেলে দিলো। কুকুর,বিড়াল আর ইঁদুর সেই ফেলে দেয়া নাড়িভুঁড়ি খেতে শুরু করলো। হটাত বিড়াল খুশীতে মিউ মিউ বলে উঠলো। বললো, মাছের নাড়িভুঁড়িতে সে উজ্জ্বল পাথর দেখতে পেয়েছে। তিনজন তখন গভীরভাবে খেয়াল করে দেখলো, এতো সেই জাদুর পাথর। খুশীতে সবাই লাফিয়ে উঠলো। বিড়াল পাথরকে নিজের মুখে নিয়ে নিলো। অতঃপর তিনজন ঘরের দিকে যাত্রা করলো।
ঘরে পৌঁছেই বিড়াল জাদুর পাথরকে যুবকের সামনে রাখলো। পাথরটি দেখতেই যুবক খুশীতে উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠলো। সে কুকুর,বিড়াল আর ইঁদুরকে বললো; তোমাদের দয়া আমি কখনোই ভুলতে পারবো না।
আমরাও জীবনভর তোমার সেবা করতে প্রস্তুত। কেননা তুমিই তো আমাদের প্রাণ বাঁচিয়েছিলে। কুকুর,বিড়াল আর ইঁদুর সমস্বরে বললো। এরপর যুবক হাসিমুখে বললো; আমি জাদুর পাথরকে নির্দেশ দিচ্ছি, স্বর্ণের মহলকে এখনি স্বস্থানে নিয়ে এসো।
মা তখন যুবককে বাঁধা দিয়ে বললেন; ব্যাটা! থাকুন না। স্বর্ণের মহলের তো আমাদের কোনো দরকারই নেই। তখন যুবক জাদুর পাথরকে পুনরায় নির্দেশ দিলো; মহলকে ধ্বংস করে দাও। মুহূর্তের মধ্যে মহল ধ্বংস হয়ে গেলো। সাথে সাথে জাদুকর, বাদশাহ, রাজকন্যা সবাই হারিয়ে গেলো। মানুষ বলে থাকে, এরপর যুবক এক মালীর মেয়েকে বিয়ে করে সুখে শান্তিতে জীবন কাটাতে শুরু করলো। সমাপ্ত…….
>মূল> *সায়্যিদা শাগুফতা। ভাষান্তর> মাসুম আহমাদ। ফেসবুকে প্রকাশিত