৯) ২৫ জানুয়ারি শনিবার বিকেলে সহপাঠী ওয়ালী উল্লাহ’র সাথে একটু কাজে ইজতেমা ময়দান থেকে বের হলাম। আসরের নামাজ মাঠ সংলগ্ন “মুহাম্মাদ সা: দারুল উলূম মাদরাসা ও ইয়াতিমখানায়” আদায় করে সামনে এগুতে লাগলাম।
বিদেশিদের জন্য নির্ধারিত খিত্তার সামনে আসা মাত্র ভিনদেশী ৩ ব্যক্তি এসে সালাম দিলেন। আমরা উত্তর দিতেই আরবিতে বললেন; তাঁরা বাজার করতে বেরিয়েছেন। বাজার কোথায়? সিম পাওয়া যাবে কি না? ইত্যাদি ইত্যাদি কথা অনবরত বলেই যাচ্ছেন। তাঁদের কথা তো ভালোমতো বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু উত্তর দিতে গিয়ে (চর্চার অভাবে) আরবি ভাষায় নিজেদের দুর্বলতা ঠের পাচ্ছিলাম। সেইসাথে মন খারাপ ভাবটা প্রকট হচ্ছিলো।
অবশেষে আল্লাহ্ তায়ালার সাহায্য আসলো। ইংরেজিতে জানতে চাইলাম; আপনারা ইংরেজি বুঝেন কি না? যখন বললেন; ইয়েস! এতো বেশি খুশি হয়েছিলাম যে, ভালোমতো আরবি বলতে না পারার দুঃখ অনেকটা ভুলে গেলাম। আলাপন বাড়তে লাগলো। তাঁরা জর্ডান থেকে ৭ জন ইজতেমায় এসেছেন। আমাদের সাথে থাকা তিনজনই শিক্ষক। শায়খ নাইফ, আর আব্দুল্লাহ’র সাথে বেশি কথা হচ্ছিলো। জানালেন; তাঁদের ২ টা সিম প্রয়োজন। আমরা সাহায্য করতে পারবো কি না?
যে পথ দিয়ে হাঁটছিলাম, সম্ভবত এই পথে পুরো জীবনে আমাদের একবারও আসা হয়নি। তবুও তাঁদের নিরাশ করতে মন চাইলো না। বললাম; জি, আমাদের সাথে আসুন। সামনে যাই। কিছুক্ষণ হাটার পর শায়খ আব্দুল্লাহ জানতে চাইলেন; আর কতক্ষণ হাটতে হবে? নিজেরাই জানি না কতক্ষণ হাঁটলে সিম কেনার দোকান খুঁজে পাবো। তবুও বললাম, আরেকটু সামনে আসুন।
পথ চলতে চলতে একসময় ইজতেমা উপলক্ষে নির্মিত অস্থায়ী একটি মার্কেটের সামনে পৌঁছুলাম। বললাম, এখানে দেখা যেতে পারে। আমরা মার্কেটের বাইরে অপেক্ষা করলাম আর সহপাঠী ওয়ালী উল্লাহ ভিতরে ঘুরে এসে জানালেন, এখানকার সব দোকান কাপড় চোপড়ে ভর্তি।
যখন বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, ভিনদেশী দেখে ছোট শিশু থেকে বৃদ্ধ মানুষেরা এসে বারবার মোসাফাহা করছিলেন। সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় ছিলো; আমার পরনে কালো লম্বা পাঞ্জাবী আর সবুজ রোমাল দিয়ে আরবদের মতো পাগড়ি থাকায় প্রায় সবাই আমাকেও ভিনদেশী ভাবছিলো। (এই সম্পর্কে অন্য সময় লিখবো)
সিম না পাওয়াতে তাঁরা বেশ হতাশ হলেন। অনেকেই আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়েছিলো। একজন মাদরাসা ছাত্রও সেখানে ছিলেন। তাঁকে যখন বললাম; কোনোভাবে সাহায্য করতে পারবেন কি না? তিনি মানিব্যাগ খুঁজে তাঁর বাংলালিংকের পুরনো একটি সিম দিয়ে দিলেন। আমি সেই ছাত্রকে টাকা দিতে চাইলে শায়খ আব্দুল্লাহ বাঁধা দিলেন এবং মূল্য জেনে ১২০ টাকা দিয়ে দিলেন।
তখনো আরেকটি সিম এবং কার্ড প্রয়োজন। ওয়ালী উল্লাহ ভাই’র সাথে আমার কথা বলা দেখে শার্ট প্যান্ট পরিহিত এক যুবক বললেন; আরেকটু সামনে গেলে সিম পাওয়া যাবে। তাঁদের যখন বললাম; সামনে যেতে রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু ভেবে দেখলাম, না জানি কতো জায়গা হাটতে হবে। এভাবে অর্ধ বয়সী এই মানুষগুলোকে কষ্ট দেয়া উচিত হবে না। এজন্য সেই যুবককে বললাম; সিম কিনতে সাহায্য করতে পারবেন কি না? রাজি হলে (যেহেতু আমি তাঁদের সাথে কথা বলছিলাম, এজন্য) ওয়ালী উল্লাহ ভাই আমায় রেখে সেই যুবকের সাথে সিম ও কার্ড কিনতে রওয়ানা হলেন।
আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করছিলাম। (পাগড়ি থাকায় সম্ভবত) আমাকে বললেন; আমি কি আরব আমিরাতে থাকি? না বলার পর বললেন; “শাকলুকা লাইসা বাঙ্গালী”।
অনেকেই এসে জানতে চাইছিলো কোন দেশি? তাঁদের পাশাপাশি আমাকে ভিনদেশী ভেবে অনেকে কাইফা হালুকা? বলছিলো। মোসাফাহা করছিলো।
গল্পের মাঝে শাইখ নাইফ বললেন; তাঁদের কিছু ব্রেড, লেবু আর টমেটো দরকার। পড়লাম বিপাকে। আমি চলে গেলে তাঁদের কথা বুঝবে কে? আবার বাজার কোথায় জানি না। তাঁদের নিয়েও যাওয়া সম্ভব নয়। এসব যখন ভাবছিলাম, দেখলাম আমার বয়সী এক ছাত্র এসে সালাম দিয়ে টুকটাক আরবিতে কথা বলতে লাগলো। যেমন, আমি হাফিজ, মাদরাসায় পড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি। তাঁকে বললাম বাজার কোথায় চিনে কি না। বললো; সামনে আছে। নির্বোধের মতো বিশ্বাস করে বললাম; একটু কষ্ট করে মেহমানদের জন্য কিছু ব্রেড, লেবু আর টমেটো নিয়ে আসতে পারবে কি না। কিছু বলছিলো না, তখন পাঁশ থেকে লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা এক ব্যক্তি বললো; আরে, সামনে থেকে নিয়ে এসো। চলো! আমিও তোমার সাথে যাবো। আমি শাইখ নাইফকে বললাম; এই ছেলে আপনাদের ব্রেড, লেবু আর টমেটো এনে দিতে পারবে। কতো লাগবে জানতে না চেয়ে ৫০০ টাকা আমার হাতে দিলেন। আমি সেই ছেলের হাতে ৫০০ টাকা দিয়ে বললাম; যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব বাজার করে এখানে চলে আসবেন। কাছাকাছি না পেলে দূরে যাবেন না। দুর্ভাগ্য! ছেলেটার সাথে মোবাইল আছে কি না জানতে চাইনি।
অপেক্ষা করতে করতে কয়েক মুহূর্ত চলে গেলো। সিম কিনতে গিয়ে ওয়ালী উল্লাহ ভাই’রও ফিরতে বিলম্ব হচ্ছিলো। মেহমানরা বিরক্ত হচ্ছিলেন। বারবার জানতে চাইছিলেন আর কতক্ষণ। মাগরিবের সময় হয়ে গেছে। আসবে তো? একসময় জানতে চাইলেন; যারা বাজার করতে গেছেন তাঁদের চিনি কি না। বললাম; একজনকে তো চিনি। অন্যজনকে মোটেও চিনি না।
যাক! মাগরিবের কয়েক মিনিট পূর্বে ওয়ালী উল্লাহ ভাই সিম আর কার্ড নিয়ে আসলেন।
অন্যদিকে ব্রেড কিনতে যাওয়া সেই হাফিজ ছেলেটির কোনো খবর নেই। অপেক্ষা চলাকালীন সাথে থাকা এক শাইখ (নাম ভুলে গেছি) নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় বললেন; ছেলেটি আসবে না। টাকা নিয়ে চলে গেছে। তখন শায়খ আব্দুল্লাহ বললেন; তোমার ধারণা ঠিক নয়। সে একজন হাফিজ। এভাবে বলো না। যদিও পরবর্তী প্রায় ৩০ মিনিট ছেলেটির অপেক্ষায় সেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, কিন্তু ফিরে আসেনি।
নতুন সিম ফোনে লাগিয়ে একটিভ করার পর ক্ষতিপূরণ বাবত আমার পকেট থেকে ব্রেড, লেবু আর টমেটোর জন্য দেয়া ৫০০ টাকা ফিরিয়ে দিতে চাইলাম । কিন্তু গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করলেন। অবশেষে আযান হয়ে যাওয়াতে বললাম; আপনারা চলে যান। সেই ছেলেটি আসলে আমরা ফোন করে পৌঁছে দেবো।
তাঁদের বিদেয় দিয়ে রাস্তায় একজনের বিছানো জায়নামাজে মাগরিবের নামায পড়লাম। অতঃপর আরো কয়েক মিনিট সেই ছেলেটির অপেক্ষা করে ওয়ালী উল্লাহ ভাই’র সাথে পরামর্শক্রমে, হাদিয়া স্বরূপ তাঁদের টমেটো আর লেবু দেয়ার জন্য মানুষকে জিজ্ঞেস করে করে, বাজারে গেলাম।
স্বল্প টাঁকার টমেটো আর লেবু কিনে ফোনে তাঁদের আসতে বলে বিদেশি স্ট্যান্ডে পৌঁছুলাম। যখন হাদিয়া হাতে দিলাম বেশ অবাক হলেন। টাকা গ্রহণের জন্য চাপাচাপি করলেন। কিন্তু হাদিয়া গ্রহণ সুন্নাত ইত্যাদি বলাতে শেষ পর্যন্ত গৃহীত হলো। অনেক দোয়া করলেন। এরপর আর যোগাযোগ হয়নি।
*এই লেখাটা আরো পরে লিখবো ভেবেছিলাম। কিন্তু গতকাল সন্ধ্যায় কয়েকজন সহপাঠীর সাথে বসে আছি, এমতাবস্থায় শাইখ নাইফের ফোন আসলো। রিসিভ করতে পারিনি। একটু পরে আমি ফোন দিলাম। কথা বলতে গিয়ে জানলাম, বর্তমানে ঢাকা থেকে প্রায় ১০০ কি. মি. দূরে কোথাও আছেন। ভালো আছেন। আমি যেন দোয়া করি। আমিও দোয়া চাইলাম।
আজ ভাবলাম; একজন ভিনদেশী আমায় এতোদিন পরেও মনে রেখেছেন। আমি তাঁদের বর্ণনা পিছিয়ে দেবো, এটা সুন্দর দেখায় না। আল্লাহ্ তায়ালা তাঁদের দাওয়াত ও তাবলীগকে ক্ববুল করুন।
>ইজতেমার বিশেষ নোটবুক থেকে…… ফেসবুকে প্রকাশিত