(১)
৭ মার্চ ১৯৭১। ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু ইনশাল্লাহ’র উপর স্বাধীনতার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর পাকিস্তানিদের পরাজিত করে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।
ইসলামী রাষ্ট্র না হলেও এদেশ বিশ্বের বুকে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। এই পরিচয়টুকু আমাদের জন্য সবসময়ই আবেগের। গৌরবের। অহংকারের।
শেখ মুজিবুর রহমান, মেজর জিয়াউর রহমান, জেনারেল এরশাদ সহ দেশের পরিচালকরা সবসময়ই ধর্মের পক্ষে ছিলেন। বাকশাল কায়েম করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু যেই ইসলামের বিপক্ষে সামান্য অবস্থান নিয়েছেন, পুরো পৃথিবী তাঁকে ত্যাগ করেছে। সবমিলিয়ে এদেশকে মুসলমানদের দেশ বলে পরিচয় দিলে সামান্যতম ভুল হবে না।
(২)
বর্তমান সরকারের প্রধান দল আওয়ামীলীগ ১৯৯৬ শাসনামলের শেষদিকে ফতোয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলো। ফতোয়া বিরোধী আন্দোলন করায় শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (রহঃ) এবং মুফতী আমিনী (রহঃ) কে কারাগারে বন্দী করেছিলো। এর বদলে ২০০১ সালের নির্বাচনে দেশের তৌহিদী জনতা ঘৃণাভরে তাদের প্রত্যাখ্যান করেছিলো।
মইনুদ্দীন, ফখরুদ্দীন সরকারের অদ্ভুত শাসনামলের পর আবার ক্ষমতায় আসে আওয়ামীলীগ সরকারের নেতৃত্বে গঠিত নামসর্বস্ব ১৪ দলীয় জোট।
ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বামপন্থী ভূতের প্রভাবে জনতার আবেগ অনুভূতিকে অসম্মান করে আওয়ামীলীগ সরকার একের পর এক ধর্মবিরোধী কার্যকলাপ পরিচালনা করেছে। ধর্মশিক্ষাহীন শিক্ষানীতি, কুরআন বিরোধী নারীনীতি, সংবিধান থেকে আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রহিতকরন সহ বিভিন্ন কার্যকলাপের মাধ্যমে সরকার বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা বামপন্থিদের প্রভাবে ভালোভাবেই মোহগ্রস্ত হয়েছে।
(৩)
সরকারের এহেন ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ড এবং ব্যাঙের ছাতার মতো হঠাৎ গজিয়ে উঠা কতিপয় শাহবাগি নাস্তিকদের শাস্তির দাবীতে শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী (দা: বাঃ) এর নেতৃত্বে দেশের আলেম সমাজ ও ধর্মপ্রাণ জনতা হেফাজতে ইসলামের পতাকা-তলে একত্রিত হয়েছেন।
ইতিমধ্যে হেফাজতে ইসলাম বিগত ০৬ এপ্রিল ঢাকার শাপলা চত্বরে লংমার্চ পরবর্তী সমাবেশ করে করে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সরকার, বিরোধীদল সহ সবগুলো রাজনৈতিক পরাশক্তির চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, দেশের জনগণ কি চায়! অরাজনৈতিক সংগঠন হয়েও হেফাজতে ইসলাম পরিকল্পিত কর্মসূচীর এক অনুপম দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে স্থাপন করেছে।
সমাবেশে হেফাজতে ইসলাম ১৩ দফা দাবী উপস্থাপন করে সরকারের কাছে দাবী বাস্তবায়নের জন্য অনুরোধ করেছে।
১৩ দফা দাবী নিয়ে ইতিমধ্যে সবজায়গায় পক্ষে/বিপক্ষে আলোচনা/সমালোচনা হয়েছে। নানা প্রশ্ন, অভিযোগ, প্রশংসা, নিন্দা করা হয়েছে। আসলেই কি বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ১৩ দফার বাস্তবায়ন সম্ভব?
(৪)
যেকোনো দাবী কিছু বাস্তব অবস্থাকে সামনে রেখে সৃষ্টি হয়। হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবীও কিছু বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে।
স্বেচ্ছা-দান এবং দাবীর মাধ্যমে কোনো কিছু আদায়ের মধ্যে পার্থক্য একজন সুস্থরুচির মানুষের পক্ষে বুঝা কঠিন নয়। দাবীর মধ্যে আলোচনা সাপেক্ষে সমাধান হয়। কখনও নির্ধারিত দাবী থেকে বেশি অর্জিত হয় তো কখনও আবার দাবী থেকে সামান্য অংশ পাওয়া যায়।
হেফাজতের ১৩ দফা দাবীর সবগুলো একই মানের নয়। ১৩ দফা যুক্তির নিরিখে কয়েকভাগে বিভক্ত। শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী (দা: বাঃ) বিভিন্ন সাক্ষাতকারে সেই প্রসঙ্গে সুস্পষ্টভাবে আলোকপাতও করেছেন।
বর্তমান প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে যেক’টি দাবী এসেছে, সেসব দাবী অবশ্যই সরকারকে পূরণ করতে হবে। এসব দাবী হচ্ছে:-
১. সংবিধানে ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃ-স্থাপন এবং কুরআন-সুন্নাহবিরোধী সব আইন বাতিল করতে হবে।
২.আল্লাহ, রাসূল সা: ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস করতে হবে।
৩. কথিত শাহবাগী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক-মুরতাদ এবং প্রিয় নবী সা:-এর শানে জঘন্য কুৎসা রটনাকারী কুলাঙ্গার ব্লগার ও ইসলাম-বিদ্বেষীদের সব অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. ইসলামবিরোধী নারীনীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৫. রাসূলপ্রেমিক প্রতিবাদী আলেম-ওলামা, মাদরাসা-ছাত্র এবং তৌহিদী জনতার ওপর হামলা, দমন-পীড়ন, নির্বিচার গুলিবর্ষণ এবং গণহত্যা বন্ধ করতে হবে।
৬. সারা দেশের কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক, ওলামা-মাশায়েখ এবং মসজিদের ইমাম-খতিবকে হুমকি-ধমকি ও ভয়ভীতি দানসহ তাদের বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে হবে।
৭. অবিলম্বে গ্রেফতারকৃত সব আলেম-ওলামা, মাদরাসা-ছাত্র ও তৌহিদী জনতাকে মুক্তিদান, দায়েরকৃত সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং আহত ও নিহতদের ক্ষতি-পূরণসহ দুষ্কৃতকারীদের বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দিতে হবে।
এই দাবীগুলো যেকোনো কিছুর বিনিময়ে হলেও সরকারকে পূর্ণ করতে হবে। অন্যতায় হেফাজতের আন্দোলন সফল হয়েছে বলা সম্ভবপর হবে না। এজন্য হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দকেও আন্তরিকভাবে সরকারের সাথে আলোচনায় বসতে হবে। অনড় অবস্থান কোনো সমাধান নিয়ে আসবে না।
উপরোল্লিখিত দাবীগুলোর পাশাপাশি অন্য যেসব দাবী রয়েছে, যেগুলো পূর্ণরূপে তৎক্ষণাৎ বাস্তবায়ন বাস্তবতার নিরিখে সম্ভবপর নয়। কিছু বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যায় না। অবশিষ্ট দাবীগুলো বাস্তবায়নের জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সরকার আন্তরিক হলেও তাদের পক্ষে এই মুহূর্তে ১৩ দফার পূর্ণ বাস্তবায়ন অসম্ভব। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে কিংবা আগামীতে আসলেও ১৩ দফা বাস্তবায়ন করতো না/করবে না কিংবা বলতে হয় করতে পারবে না।
সরকারকে বিভিন্ন দিক সামলে চলতে হয়। নিজেদের গদি ঠিক রাখতেই বিদেশি প্রভুদের পা চাঁটতে হয়। ফলে ভোট ব্যবসায়ী ছাড়া তাদের অন্য পরিচয় নেই বললেই চলে। ইসলাম তাদের কাছে ধর্মের চাইতে ধার্মিকদের মন জয় করার হাতিয়ার হিসেবেই বেশি মূল্যবান।
এর পাশাপাশি মনে রাখতে হবে যে, বর্তমান সরকার ইসলাম এবং মুসলমানদের আবেগ অনুভূতিকে মূল্যায়ন করছে না। ইসলামের মমত্ববোধ তাদের হৃদয়ে প্রভাব ফেলেনি। ক্ষমতার নেশায় তারা বধির হয়ে গেছে। ফলে এই মুহূর্তে ১৩ দফা পরিপূর্ণরূপে আদায়ের একমাত্র উপায় সহিংস আন্দোলন। আর এই মুহূর্তে সহিংস আন্দোলন কতোটুকু যৌক্তিক প্রশ্নসাপেক্ষ।
(৫)
হেফাজতে ইসলাম কওমি মাদরাসার অনুসারীদের মনে আশার ফুল হয়ে এসেছে। বসন্তের কোকিলের মতো হেফাজতকে ভাবলে ভুল করবেন।
সফলতার মালিক আল্লাহ তায়ালা। সহিংস আন্দোলন করে বিজয়ী হবো নাকি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো একমাত্র আল্লাহ তায়ালা বলতে পারবেন। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটের দাবী অনুযায়ী আমার ধারণা অনুযায়ী সহিংসতা অবলম্বনের সময় আসেনি। আমরা সংগঠিত নই। বর্তমান মুহূর্তকে আমরা নিজেদের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠার জন্য চমৎকার সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতে পারি। এজন্য আমাদের সামনে রয়েছে দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার স্মরণীয় ইতিহাস।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর পরই উত্তর ভারতের দেওবন্দ কেন্দ্রিক যে দ্বীনি শিক্ষাধারা চালু হয়েছিল এখন তা এ উপমহাদেশসহ গোটা দুনিয়ায় কওমী মাদরাসা শিক্ষা নামে বেশ সুখ্যাতি লাভ করে। যুদ্ধ নয়, হিকমাতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা উপমহাদেশে ইসলামের পতাকাকে সমুন্নত করেছিলেন।
দেশ পরিচালনায় আমাদের অদক্ষতা, মিডিয়ার সাথে সম্পর্কহীনতা, যুগের চাহিদার বিপরীতে আমাদের দুর্বলতা, পারস্পরিক কুৎসিত ধারণা, রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি কাটিয়ে উঠার এখনি সুযোগ। শায়খুল ইসলাম মাদানী (রহঃ) বলেছিলেন, অখণ্ড ভারতে মুসলমানরা নিজেদের উত্তম আখলাকের মাধ্যমে একদিন সবার মন জয় করে এককভাবে দেশ পরিচালনা করবে ইনশাল্লাহ। শায়খুল ইসলামের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি, তবে পরিকল্পনা আমাদের সামনে রয়ে গেছে।
এই মুহূর্তে যদি সরকার কোনোভাবে ১৩ দফা দাবী মেনে নেয়, তবে আমরা বিশ্ব জয় করেছি মনে করা উচিত হবে না। একদিন এদেশে ইসলামের পতাকা উড়বে। সেটা হয়তো ১০০ বছর পরেও হতে পারে। আগামি শতবছরের পরিকল্পনাটা হেফাজতে ইসলামের ছায়াতলে হোক। এজন্য ধীর গতিতে এগুতে হবে। ১৩ দফা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হেফাজতে ইসলাম মৃত্যুকে যেন গ্রহণ না হয় এই ভাবনা সামনে রাখতে হবে। আল্লাহ’র সাহায্য অচিরেই আসবে ইনশাল্লাহ।
*সম্পূর্ণ নিজস্ব ভাবনা শেয়ার করলাম। খারাপ লাগলে ক্ষমা করবেন। কিছু অংশ পড়ে আপনি আমাকে দুর্বল ভাবতে পারেন। কাপুরুষ বলতে পারেন। কিন্তু মনে রাখবেন; মানুষের ভাবনার ভিন্নতার ফলেই বিশ্ব আজ বৈচিত্র্যময়। হর গুলে রা রঙ ও বুয়ে দীগর আস্ত। ৩০ এপ্রিল ২০১৩, ফেসবুকে প্রকাশিত